সাগর কলা চাষ পদ্ধতি : বিস্তারিত নির্দেশিকা

সাগর কলা

সাগর কলা

বাংলাদেশে সাগর কলা একটি জনপ্রিয় ফল, যা পুষ্টিগুণ ও বাণিজ্যিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাগর কলা চাষ করে কৃষকরা যেমন ভালো মুনাফা অর্জন করতে পারেন, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কলা চাষ পদ্ধতির সঠিক জ্ঞান থাকা, উপযুক্ত জমি নির্বাচন, সঠিক জাত নির্বাচন, পরিচর্যা ও সার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়গুলো জানলে কৃষকরা ভালো ফলন পেতে পারেন। এই লেখায় সাগর কলা চাষের বিভিন্ন ধাপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

কলা পরিচিতি
কলা (Musa spp.) হল এক প্রকার বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ যার কাণ্ড মাটির নীচে থাকে এবং মাটির উপরের অংশ থেকে নতুন পাতা গজায়। কলার উদ্ভিদটি মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত হলেও এখন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এর চাষ হয়। কলা ফল যেমন পুষ্টিকর তেমনি সহজপাচ্য এবং সারা বছর ধরে পাওয়া যায়। এর মধ্যে সাগর কলা বিশেষভাবে জনপ্রিয়।

 সাগর কলার বৈশিষ্ট্য
সাগর কলা একটি দীর্ঘ ও কিছুটা বাঁকা আকারের ফল, যা কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে হলুদ রঙের হয়। এর ভিতরে থাকা সাদা মাংসল অংশ মিষ্টি ও সুস্বাদু। সাগর কলা ছোট থেকে বড় প্রতিটি আকারে পাওয়া যায়। এই কলার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
বাহ্যিক রং: সবুজ থেকে হলুদ
আকার: ১০-১৫ সেন্টিমিটার
মাংসল: ঘন এবং সুস্বাদু
চাষের সময়: সারাবছর
পুষ্টিগুণ: ভিটামিন বি৬, সি, পটাশিয়াম, এবং আঁশে ভরপুর

সাগর কলা চাষ পদ্ধতি,  উপযুক্ত আবহাওয়া ও মাটি
সাগর কলার ভাল ফলনের জন্য সুনির্দিষ্ট আবহাওয়া ও মাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আবহাওয়া
সাগর কলা চাষের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া সবচেয়ে উপযুক্ত। এটি সমুদ্রের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পছন্দ করে, কারণ অতিরিক্ত শীতলতা বা খরাপ্রবণ এলাকায় ফলন কমে যেতে পারে।
তাপমাত্রা: ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস
বৃষ্টিপাত: ১২০-১৫০ সেন্টিমিটার
আর্দ্রতা: ৬০-৭০% (তবে উচ্চ আর্দ্রতায় ছত্রাকের আক্রমণ বাড়ে, যা রোধ করার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়)

কলা চাষের উপযুক্ত মাটি
মাটির উর্বরতা ও পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা কলা চাষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাগর কলার জন্য হালকা বেলে দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত।
পিএইচ: ৫.৫-৭.০
নিষ্কাশন: ভালো নিষ্কাশন ক্ষমতা থাকা জরুরি, কারণ জমে থাকা পানি শিকড়কে পচিয়ে ফেলতে পারে।
জৈব পদার্থ: জৈব সার সমৃদ্ধ মাটিতে ভালো ফলন হয়।

 সাগর কলার জাত নির্বাচন
সাগর কলার বিভিন্ন জাত রয়েছে, তবে বাংলাদেশে এবং ভারতের অনেক অঞ্চলে বেশ কিছু জনপ্রিয় জাতের চাষ হয়ে থাকে। এই জাতগুলি ফলনের দিক থেকে এবং রোগ প্রতিরোধের দিক থেকেও আলাদা হয়ে থাকে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ জাত
1. সাগর কলা (বৈশিষ্ট্য): উচ্চ ফলনশীল জাত। একেকটি ফলের ওজন প্রায় ১০০-১৫০ গ্রাম হয়।
2. কাভেন্দিশ জাত: গড় ফলন ও মিষ্টতার জন্য পরিচিত।
3. দোয়েল জাত: পোকামাকড়ের আক্রমণ রোধ করতে পারদর্শী জাত।

জমি প্রস্তুতি
সঠিকভাবে জমি প্রস্তুত করা সাগর কলা চাষে সফলতার প্রথম ধাপ। জমি প্রস্তুতির জন্য কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে চলা উচিত।

জমি প্রস্তুতির ধাপ
1. জমি পরিষ্কার করা: জমির আগাছা, গাছের শিকড় এবং পাথরসমূহ পরিষ্কার করতে হবে।
2. চাষ ও চপিং: চাষ ও চপিং করে মাটির ঢেলা ভেঙে নরম করা উচিত।
3. জৈব সার ব্যবহার: গরুর গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করা উচিত। প্রতি বিঘাতে প্রায় ১০-১৫ কেজি জৈব সার প্রয়োজন।
4. জমি নির্দিষ্ট করা: প্রতি ২-৩ মিটার দূরত্বে চারা লাগানোর জন্য জমি নির্দিষ্ট করতে হবে।

 সাগর কলার রোপণ পদ্ধতি
সাগর কলা চাষের মূল ধাপ হলো সঠিক পদ্ধতিতে কলার চারা রোপণ করা। রোপণের সময় মাটি ও আবহাওয়ার শর্তগুলো মাথায় রাখতে হবে।

রোপণের সময়
সাগর কলার চারা বসানোর সময় সাধারণত বৃষ্টির মৌসুমের আগে অথবা বর্ষার শেষে উপযুক্ত। কারণ বর্ষার পানিতে চারা দ্রুত গজায় এবং মাটির আর্দ্রতা বজায় থাকে।
সেরা সময়: জুন-জুলাই
বিকল্প সময়: ফেব্রুয়ারি-মার্চ

চারা রোপণের পদ্ধতি
গর্ত তৈরি: প্রতিটি গাছের জন্য ৫০ সেমি x ৫০ সেমি x ৫০ সেমি আকারের গর্ত খোঁড়া উচিত।
সার প্রয়োগ: গর্তের নিচে ৫-১০ কেজি জৈব সার এবং ১০০-১৫০ গ্রাম পটাশ প্রয়োগ করতে হবে।
চারা রোপণ: গর্তে চারা বসিয়ে মাটি দিয়ে চেপে দেওয়া উচিত এবং সাথে সাথে পানি দিতে হবে।

পরিচর্যা
সাগর কলা চাষে নিয়মিত পরিচর্যা ও যত্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গাছের বৃদ্ধির সময় এবং ফল ধরার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের পরিচর্যা করতে হবে।

পানি সেচ
কলার গাছে নিয়মিত পানি সরবরাহ করা অত্যন্ত জরুরি। পানি কম পেলে ফলন কম হবে এবং গাছ দুর্বল হয়ে যাবে। বর্ষার মৌসুমে অতিরিক্ত পানি জমা হতে দেওয়া যাবে না।
সেচের সময়: প্রতি ৫-৭ দিন অন্তর সেচ দেওয়া উচিত।
পদ্ধতি: সেচ দেওয়ার জন্য ড্রিপ ইরিগেশন সবচেয়ে উপযুক্ত, কারণ এতে পানির অপচয় কম হয়।

আগাছা দমন
জমিতে আগাছা জন্মালে তা গাছের পুষ্টি শোষণ করে ফেলে, তাই নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করা জরুরি।

সার ব্যবস্থাপনা
কলার ভাল ফলন পেতে সার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করলে ফলন বৃদ্ধি পায়।
1. ইউরিয়া: প্রতি গাছে ২০০-২৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে।
2. পটাশ: প্রতি গাছে ৩০০-৩৫০ গ্রাম প্রয়োজন।
3. ফসফেট: প্রতি গাছে ১৫০-২০০ গ্রাম প্রয়োগ করা উচিত।

রোগবালাই ও প্রতিরোধ
সাগর কলার গাছে বিভিন্ন রোগবালাই আক্রমণ করতে পারে। এগুলোর প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরি।

সাধারণ রোগসমূহ
1. পানামা রোগ: এটি এক ধরনের ফাঙ্গাসজনিত রোগ, যা গাছের পাতা শুকিয়ে ফেলতে পারে।
প্রতিকার: আক্রান্ত গাছগুলো কেটে ফেলা এবং মাটির সাথে সালফার প্রয়োগ করা।

2. পাতা দাগ রোগ: পাতার ওপর দাগ পড়ে, যা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
প্রতিকার: কীটনাশক ব্যবহার।

পোকামাকড় আক্রমণ
1. রুট উইভিল: কলার শিকড়ের ক্ষতি করে, ফলে গাছ দুর্বল হয়ে যায়।
প্রতিকার: মাটিতে কীটনাশক প্রয়োগ।

2.ব্যানানা অ্যাফিড: পাতায় লেগে গাছের পুষ্টি শোষণ করে।
প্রতিকার: কীটনাশক প্রয়োগ এবং আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *