হামাস কোন দেশের সংগঠন: ইতিহাস, উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রমের বিশদ বিবরণ

হামাস কোন দেশের সংগঠন

হামাস কোন দেশের সংগঠন:

হামাস, একটি আলোচিত ও বিতর্কিত রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগঠন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে ও বাইরের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রেক্ষাপটে হামাসের ভূমিকা এবং কার্যক্রম ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা হামাস কোন দেশের সংগঠন, তার উত্থান, ইতিহাস, রাজনৈতিক আদর্শ, এবং সাম্প্রতিক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

 হামাসের উত্থান ও ইতিহাস

১. উৎপত্তি ও প্রতিষ্ঠা

হামাসের উত্থান ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। হামাস (Hamas) শব্দটি আরবি “حركة المقاومة الإسلامية” এর সংক্ষিপ্ত রূপ, যার অর্থ “ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন”। হামাস ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের প্রথম অন্তিফাদার সময়। এই আন্দোলন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে।

প্রাথমিকভাবে, হামাস ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা, যার উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনের মুক্তি এবং ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো। মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শ থেকে প্রভাবিত হয়ে হামাস ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় আন্দোলন হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।

২. ইসলামিক প্রতিরোধের চেতনা

হামাসের রাজনৈতিক আদর্শ ইসলামের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সংগঠনটি ফিলিস্তিনের মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের চেতনার মাধ্যমে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের আহ্বান জানায়। তাদের চার্টার, যা ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়, তাতে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং ফিলিস্তিনকে ঐতিহাসিকভাবে একটি মুসলিম ভূমি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

৩. গাজা স্ট্রিপে আধিপত্য

হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা ২০০৬ সালের ফিলিস্তিনি আইনসভা নির্বাচনে বড় ধরনের বিজয়ের পর থেকেই বৃদ্ধি পায়। এই নির্বাচনে হামাস ৭৬টি আসনের মধ্যে ৭৪টি আসন জিতে নিয়ে ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে শক্তিশালী প্রভাব স্থাপন করে। এরপর ২০০৭ সালে, হামাস ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (পিএলও) এবং ফাতাহের সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে, যার ফলে হামাস গাজা স্ট্রিপে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

গাজা স্ট্রিপ হামাসের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিগণিত হয়, যেখানে তারা রাজনৈতিক এবং সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। হামাসের এই আধিপত্য গাজা স্ট্রিপের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে, এবং এটি ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলির সাথে সম্পর্কেও জটিলতা সৃষ্টি করেছে।

হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক আদর্শ

হামাসের রাজনৈতিক আদর্শ এবং সামরিক কৌশল তাদের কার্যক্রম এবং তাদের সাথে জড়িত সঙ্কটগুলো বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনের মুক্তি এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা, যা ইসলামি নীতি ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে।

১. সশস্ত্র প্রতিরোধ ও সামরিক কর্মসূচি

হামাসের সামরিক শাখা “ইজ্জাদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড” ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং হামাসের সামরিক অভিযানগুলো আন্তর্জাতিকভাবে বহু বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। হামাসের এই সশস্ত্র কর্মকাণ্ড তাদেরকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইসরায়েলের কাছে।

হামাসের সামরিক কৌশলের মধ্যে রয়েছে রকেট আক্রমণ, সুরঙ্গ নির্মাণ, এবং বিভিন্ন গেরিলা কৌশল, যা ইসরায়েলের সামরিক ও অসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। যদিও হামাসের দাবি এটি ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিরক্ষার একটি অংশ, আন্তর্জাতিক মহলে এটি প্রায়ই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়।

২. রাজনৈতিক আদর্শ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ

হামাস শুধুমাত্র একটি সামরিক সংগঠন নয়, এটি ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলও। তারা গাজা স্ট্রিপের প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করে এবং সেখানে সামাজিক সেবামূলক কার্যক্রমও পরিচালনা করে থাকে। হামাসের রাজনৈতিক আদর্শে ইসলামের প্রভাব স্পষ্ট, এবং তারা একটি ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। তাদের চার্টারে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং ফিলিস্তিনের সম্পূর্ণ মুক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

 হামাসের আন্তর্জাতিক প্রভাব

১. মধ্যপ্রাচ্যে হামাসের সম্পর্ক

হামাসের প্রভাব শুধুমাত্র ফিলিস্তিন বা ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশেষত ইরান, কাতার, এবং তুরস্ক হামাসকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। ইরান, যা দীর্ঘদিন ধরে হামাসকে সমর্থন করে আসছে, ইসরায়েল বিরোধী প্রচারণায় তাদেরকে শক্তিশালী মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে।

২. বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক

হামাসের কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইসরায়েল হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে, এবং এর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়। তবে অন্যদিকে, কিছু দেশ এবং রাজনৈতিক দল হামাসকে ফিলিস্তিনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করে, এবং তাদের কার্যক্রমকে প্রতিরোধ আন্দোলনের অংশ বলে মনে করে।

 ৩. ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মধ্যে হামাসের ভূমিকা

হামাস ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের একটি প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত। গাজার নিয়ন্ত্রণ এবং ইসরায়েলের সাথে তাদের সংঘাত ফিলিস্তিনি ইস্যুতে একটি জটিলতা সৃষ্টি করেছে। হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতগুলো সাধারণত রকেট হামলা এবং প্রতিশোধমূলক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যা সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

হামাস কোন দেশের সংগঠন: হামাস ও ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে হামাসের প্রভাব ও তার অবস্থান ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য একটি দ্বিধাবিভক্ত প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করেছে। হামাস এবং ফাতাহের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে গাজা স্ট্রিপে হামাসের আধিপত্যের কারণে, ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে।

১. হামাস বনাম ফাতাহ

ফাতাহ, যা পিএলও-এর অংশ, দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তবে ২০০৬ সালের নির্বাচনের পর হামাসের উত্থান ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে ক্ষমতার সংঘাতের ফলে গাজা এবং পশ্চিম তীরে দুটি ভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামো সৃষ্টি হয়েছে, যা ফিলিস্তিনি ঐক্যের পথে একটি বড় বাধা।

২. গাজা স্ট্রিপের জীবনযাত্রা

হামাসের নেতৃত্বাধীন গাজা স্ট্রিপে জীবনযাত্রা চরম সংকটাপন্ন। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক অবরোধ, হামাসের সামরিক কার্যক্রম, এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে গাজার জনগণকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। বেকারত্ব, খাদ্য সংকট, এবং চিকিৎসা সুবিধার অভাব গাজার একটি সাধারণ চিত্র হয়ে উঠেছে।

উপসংহার

হামাস একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক সংগঠন, যা ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক, সামরিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে হামাসের ভূমিকা সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন, কারণ এটি মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর রাজনীতি এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

হামাসের উত্থান, রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ড, এবং ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে এর প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং শান্তি প্রক্রিয়ার একটি বড় অংশ হিসেবে বিবেচিত।

One thought on “হামাস কোন দেশের সংগঠন: ইতিহাস, উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রমের বিশদ বিবরণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *