সিরিয়া, দামেস্ক এবং বাশার আল আসাদ

সিরিয়া, দামেস্ক এবং বাশার আল আসাদ

ভূমিকা

সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, যার একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। এর রাজধানী দামেস্ক বিশ্বের প্রাচীনতম ধারাবাহিকভাবে বসবাস করা শহরগুলির একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। আধুনিক সিরিয়া যদিও রাজনৈতিক সংঘর্ষ, গৃহযুদ্ধ এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার কারণে আন্তর্জাতিক মনোযোগে উঠে এসেছে, বিশেষত ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এবং তার সরকারকে কেন্দ্র করে। সিরিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনের ওপর এই সংঘাতের গভীর প্রভাব রয়েছে। এই ব্লগ পোস্টে সিরিয়া, দামেস্ক এবং বাশার আল আসাদের রাজনৈতিক উত্থান ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হবে।

সিরিয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

সিরিয়া প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিখ্যাত। এটি ফারাও, ব্যাবিলনীয়, পার্সিয়ান, গ্রীক, রোমান এবং ইসলামিক সাম্রাজ্যের মতো বিভিন্ন শক্তির শাসনাধীনে ছিল। দামেস্ক শহরটি খ্রিস্টপূর্ব ১০০০০ সাল থেকে বসবাসের উপযুক্ত ছিল বলে মনে করা হয় এবং এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর। ইসলামিক যুগে এটি উমাইয়া খিলাফতের (৬৬১-৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) রাজধানী ছিল, যার ফলে এটি ইসলামিক ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।

১৯২০ সালের দিকে সিরিয়া ফ্রান্সের অধীনে আসে এবং ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর থেকেই সিরিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা চলছিল, যা ১৯৭০ সালে হাফিজ আল আসাদের নেতৃত্বাধীন বাথ পার্টির ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে এক ধরনের স্থিতিশীলতায় আসে। হাফিজ আল আসাদ সিরিয়ায় দীর্ঘকালীন শাসন চালান এবং ২০০০ সালে তার মৃত্যুর পর তার ছেলে বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় আসেন।

দামেস্ক : সিরিয়ার হৃদয়

দামেস্ক, সিরিয়ার রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় শহর, শুধু দেশটির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্রই নয়, বরং এটি সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্বেও সমৃদ্ধ। দামেস্ক ইসলামিক বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে উমাইয়া মসজিদের জন্য বিখ্যাত, যা ইসলামের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম মসজিদগুলোর একটি। এটি প্রাচীনকালের একটি সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রও ছিল, যা সিল্ক রোডের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথের সংযোগস্থল ছিল।

দামেস্ক তার প্রাচীন স্থাপত্য, বাজার, এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। দামেস্ক শহরটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত এবং তার প্রাচীন এলাকাগুলি এখনও দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় অনেক ঐতিহাসিক স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং শহরের অনেক অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও, দামেস্ক আজও সিরিয়ার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে টিকে আছে।

বাশার আল আসাদের রাজনৈতিক উত্থান

বাশার আল আসাদ ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার বাবা হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। তার শাসনামলের প্রথম দিকে, তিনি সিরিয়ার জনগণের কাছে তুলনামূলকভাবে উদার এবং সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে দেখা দেন। তিনি স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু আধুনিকায়ন প্রচেষ্টা চালান। তবে আস্তে আস্তে তার শাসন কঠোর হয়ে ওঠে, বিশেষত ২০১১ সালে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের পর থেকে।

বাশার আল আসাদ মূলত তার বাবার মতো বাথ পার্টির ক্ষমতাকে মজবুত করেন। তিনি তার শাসনের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের বিরোধিতা কঠোরভাবে দমন করেন। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভগুলি দ্রুতই গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়, যা আজও সিরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। আসাদ সরকার তার শাসন টিকিয়ে রাখতে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালায়, যার ফলে সিরিয়ার অনেক অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব

গৃহযুদ্ধটি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে জটিল এবং বিধ্বংসী সংঘর্ষগুলির একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসাদ সরকার প্রথম থেকেই বিক্ষোভকারীদের দমন করতে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে এবং এটি আরও সহিংসতা বাড়িয়ে তোলে। বিরোধী দলগুলির মধ্যে একাধিক গোষ্ঠী, যেমন মুক্ত সিরিয়ান আর্মি, ইসলামিক স্টেট (আইএসআইএস), এবং কুর্দি মিলিশিয়া গঠন হয়। এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্য রয়েছে, যা সংঘাতকে আরও জটিল করে তোলে।

গৃহযুদ্ধের ফলে লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান নিহত হয়েছেন এবং আরও কয়েক মিলিয়ন মানুষ শরণার্থী হিসেবে দেশত্যাগ করেছেন। যুদ্ধের প্রভাব শুধু সিরিয়ার ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়া এবং ইরান আসাদ সরকারের পক্ষে সরাসরি সামরিক এবং রাজনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছে, যা আসাদকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিরোধী দলগুলোর প্রতি সমর্থন দেখিয়েছে, তবে তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ সীমিত ছিল।

আসাদের শাসন : আধিপত্য এবং বিরোধিতা

বাশার আল আসাদের শাসনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তার শাসনকাল জুড়ে সামরিক শক্তি ব্যবহার এবং রাজনৈতিক বিরোধিতা দমন করা। জনগণের বৃহৎ অংশ তার শাসনের বিরুদ্ধে হলেও তিনি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তার ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। আসাদ সরকার বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে, বিশেষত বেসামরিক নাগরিকদের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার এবং অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে।

তবে, আসাদের সমর্থকরাও রয়েছেন, যারা মনে করেন যে তার শাসন দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছে। তারা মনে করেন, আসাদ না থাকলে সিরিয়া সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যেত। এই সমর্থন মূলত শিয়া সম্প্রদায়, আলাওয়াইট সম্প্রদায় এবং কিছু ব্যবসায়িক মহল থেকে আসে, যারা মনে করেন যে আসাদ সরকার তাদের সুরক্ষা এবং স্থিতিশীলতা প্রদান করেছে।

সিরিয়ার ভবিষ্যত

বর্তমানে সিরিয়ার অবস্থা অত্যন্ত জটিল। গৃহযুদ্ধের প্রাথমিক সময়ের তুলনায় আসাদের শাসন অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে, তবে দেশটি এখনও বিভক্ত এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত। সিরিয়ার অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়েছে, এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়া দীর্ঘ এবং কষ্টকর হবে। অনেক অঞ্চল এখনও আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাবেও সিরিয়া দীর্ঘমেয়াদী পুনর্গঠনের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।

 

সিরিয়ার “স্বৈরশাসক”

সিরিয়ার “স্বৈরশাসক” হিসেবে সাধারণত বাশার আল আসাদকে উল্লেখ করা হয়। তিনি ২০০০ সাল থেকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। তার পিতা হাফিজ আল-আসাদও ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যা আসাদ পরিবারের দীর্ঘকালীন শাসন প্রতিফলিত করে।

সিরিয়া, দামেস্ক এবং বাশার আল আসাদ
Bashar Al-Assad

বাশার আল আসাদকে “স্বৈরশাসক” বলা হয় কারণ তার শাসনামলে বহু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হয়েছে, এবং বিভিন্ন সময়ে বিরোধী দল ও আন্দোলনকারীদের ওপর দমনপীড়ন চালানো হয়েছে। ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আসাদ সরকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর দমনমূলক পদক্ষেপ নেয়। এই সময়ে ব্যাপক সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সাধারণ জনগণের ওপর আক্রমণের অভিযোগ আসে আসাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে।

গৃহযুদ্ধের সময় বাশার আল আসাদ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমর্থন (বিশেষ করে রাশিয়া এবং ইরান থেকে) পেয়ে তার শাসন ধরে রেখেছেন। এ কারণে তার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, যদিও তার শাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্ক রয়েছে এবং তাকে স্বৈরাচারী নেতা হিসেবে সমালোচনা করা হয়।

বাশার আল-আসাদের মোট সম্পদের পরিমাণ :

বাশার আল-আসাদের মোট সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে নির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন যে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট  ও তার পরিবার বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক। তারা সিরিয়ার অর্থনীতির প্রধান খাতগুলো (যেমন, তেল, গ্যাস, টেলিকমিউনিকেশন এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক খাত) নিয়ন্ত্রণ করে আসছে, যা তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেছে।

কিছু অনুমানের ভিত্তিতে আসাদের মোট সম্পদের পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে। যদিও এই তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত নয়, তবে ২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিরিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যার মধ্যে আসাদ পরিবারের সম্পদও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আসাদের সম্পদ সংক্রান্ত বিষয়টি সাধারণত রাজনৈতিক অবস্থা এবং গোপনীয়তার কারণে নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না।

উপসংহার

সিরিয়া, তার প্রাচীন রাজধানী দামেস্ক এবং বাশার আল আসাদের শাসন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এটি একদিকে ইতিহাসের মহিমা এবং অন্যদিকে সমসাময়িক সংঘাতের এক অত্যন্ত কঠিন বাস্তবতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সিরিয়া তার ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। একসময়কার সমৃদ্ধশালী সিরিয়া এবং দামেস্ক  এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত, কিন্তু এর জনগণের আশা ও সহ্যশক্তি এখনও টিকে আছে। সিরিয়ার ভবিষ্যত নির্ভর করছে রাজনৈতিক সমঝোতা, আন্তর্জাতিক সমর্থন, এবং গৃহযুদ্ধের সমাধানকরণের ওপর।

আরও পড়ুন :

কিম জং উন উত্তর কোরিয়ার নেতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *