মুহাম্মদ ইউনূস

ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস এবং বর্তমান বাংলাদেশ

ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস এবং বর্তমান বাংলাদেশ ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ, সমাজকর্মী এবং মানবতাবাদী। মাইক্রোক্রেডিট ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর অবদান শুধু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নয়, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। তিনি ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন, যা তাঁকে একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আরও প্রসিদ্ধ করে তোলে। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ডক্টর ইউনুসের ভূমিকা ও তার কার্যক্রম নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক এবং আলোচনা রয়েছে। এই প্রবন্ধে তাঁর জীবনী, অবদান, এবং বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাঁর অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসের জীবনী ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস ১৯৪০ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষাজীবন অত্যন্ত উজ্জ্বল ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি দেশের কৃষক ও দরিদ্র মানুষদের দুঃখ-কষ্ট প্রত্যক্ষ করেন, যা তাঁর ভবিষ্যতের কাজকে অনুপ্রাণিত করে। এই সংকট থেকেই তিনি গ্রামীণ ব্যাংক এবং মাইক্রোক্রেডিট ধারণার বিকাশ ঘটান, যা দারিদ্র্য বিমোচনের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং মাইক্রোক্রেডিট ১৯৭৬ সালে ডক্টর ইউনুস চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে মাইক্রোক্রেডিটের ধারণা শুরু করেন। তাঁর এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল দরিদ্র মানুষদের, বিশেষত নারীদের, সামান্য মূলধন দিয়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া। এরপর তিনি ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বের প্রথম মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। গ্রামীণ ব্যাংকের বিশেষত্ব হলো, এখানে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে থাকা দরিদ্র মানুষদের ঋণ দেওয়া হয়, কোনোরকম জামানত ছাড়াই। এই ঋণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করে এবং নিজেরা স্বাবলম্বী হতে পারে। মূলত নারীদের ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ডক্টর ইউনুসের মাইক্রোক্রেডিট মডেল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন দেশে গৃহীত হয়। এই মডেলটির সফলতা তাঁকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি এনে দেয় এবং ২০০৬ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস   রাজনৈতিক বিতর্ক এবং চ্যালেঞ্জসমূহ ডক্টর ইউনুস বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশাল অবদান রাখলেও, সাম্প্রতিক সময়ে তিনি রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। ২০১১ সালে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অবসর নেওয়ার সময় আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতার মুখোমুখি হন। তৎকালীন সরকারের সাথে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। ডক্টর ইউনুসের একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল, তিনি ২০০৭ সালে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদিও সেই উদ্যোগ সফল হয়নি, তবুও এই পদক্ষেপ তাঁকে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সরকার তাঁকে কর ফাঁকির অভিযোগে এবং অন্যান্য আইনি জটিলতায় জড়ানোর চেষ্টা করেছে।   গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে ডক্টর ইউনুসের সম্পর্ক বর্তমান সরকারের সাথে তিক্ত হয়ে ওঠে, যখন সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। সরকার দাবি করে যে, গ্রামীণ ব্যাংক একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো পরিচালিত হওয়া উচিত, যেখানে সরকার প্রধান ভূমিকা পালন করবে। অন্যদিকে ডক্টর ইউনুস এবং তাঁর সমর্থকরা মনে করেন যে, গ্রামীণ ব্যাংককে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হতে দেওয়া উচিত।   আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং সমালোচনা ডক্টর ইউনুস আন্তর্জাতিকভাবে এখনও একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন তাঁর মাইক্রোক্রেডিট মডেলকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এখনও তাকে দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করে। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মহলে তাঁর সমালোচকরা মনে করেন যে, ডক্টর ইউনুস বিদেশি সমর্থন কাজে লাগিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন। তাঁর অর্থনৈতিক নীতির কার্যকারিতা নিয়ে দেশে-বিদেশে কিছু বিতর্ক রয়েছে।   সাম্প্রতিক উদ্যোগ এবং সামাজিক ব্যবসা ডক্টর ইউনুস বর্তমানে সামাজিক ব্যবসার ধারণা নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সামাজিক ব্যবসা বা সোশ্যাল বিজনেসের মাধ্যমে মানুষের সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব, যেখানে মূল লক্ষ্য মুনাফা নয় বরং সমাজের কল্যাণ সাধন। তাঁর সোশ্যাল বিজনেস উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। সামাজিক ব্যবসার ধারণা অনুযায়ী, ব্যবসা পরিচালনা করে ব্যবসার মালিকরা শুধুমাত্র নিজেদের বিনিয়োগের টাকা ফেরত পাবেন, কিন্তু ব্যবসার থেকে মুনাফা নেওয়া হবে না। এর মাধ্যমে সমাজের দুর্বল অংশগুলোকে সহায়তা করা হবে। বাংলাদেশের সমাজে ডক্টর ইউনুসের প্রভাব ডক্টর ইউনুসের কাজ এবং চিন্তাধারা বাংলাদেশের সমাজের বিভিন্ন স্তরে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক উন্নয়নে তাঁর উদ্যোগগুলো ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে এবং দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন জীবন এসেছে। তাঁর মাইক্রোক্রেডিট মডেল বাংলাদেশে প্রভাবশালী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের রূপান্তর ঘটিয়েছে। যদিও বর্তমান সরকার ও ডক্টর ইউনুসের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য রয়েছে, তারপরও তাঁর কাজ এবং অবদান দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। উপসংহার ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যিনি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। তাঁর মাইক্রোক্রেডিট এবং গ্রামীণ ব্যাংক মডেল বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের একটি কার্যকরী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর অবস্থান এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। তবে, এই বিতর্কের মাঝেও তাঁর সামাজিক ব্যবসা এবং দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশ্য তাঁকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যতের জন্য উদ্যমী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

Read More